কমিউনিটি ক্লিনিক: একটি গণমূখী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা
পটভূমি :
বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত মহান মুক্তি যুদ্ধ এবং ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে। স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধস্ত এ দেশকে গড়তে এবং স্বাস্ব্যখাতের উন্নয়নে বিভিন্ন বাস্তবধর্মী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। তৃণমূল পর্যায়ে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে স্বাস্থ্য সেবা কার্যক্রমকে বিকেন্দ্রীকরণের পদক্ষেপ হিসাবে থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠা করেন। এর মাধ্যমে ধাপে ধাপে তৃণমূল পর্যায়ে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা চালানো হয়। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা আয়োজিত ১৯৭৮ সালের আলমা-আটা শীর্ষ সম্মেলনের ঘোষণাপত্রে বাংলাদেশ অন্যতম স্বাক্ষরকারী দেশ। আলমা আটার ঘোষণা ছিল প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার মাধ্যমে “২০০০ সনের মধ্যে সবার জন্য স্বাস্থ্য”। কিন্তু ১৯৯৬ সনের সমীক্ষায় দেখা যায় যে, বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশ লক্ষ্যের চেয়ে অনেক পিছিয়ে আছে। ১৯৯৬ সালে গ্রামীণ দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মানসম্মত প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। মূলত জনগণের অংশগ্রহণে গ্রামীণ মানুষের দোরগোড়ায় প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা পৌঁছে দেওয়াই ছিল লক্ষ্য।
কমিউনিটি ক্লিনিক হলো একটি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত কার্যক্রম যা Community Based Health Care (CBHC) অপারেশনাল প্ল্যান এর মাধ্যমে বাস্তবায়িত হচ্ছে এবং সরকারের সাফল্যের এক উজ্জল দৃষ্টান্ত যা দেশে-বিদেশে নন্দিত। এ কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশের দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত গ্রামীণ জনগণ নিকটস্থ কমিউনিটি ক্লিনিক হতে সমন্বিত স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা ও পুষ্টি সেবা পাচ্ছেন। এটি জনগন ও সরকারের যৌথ প্রয়াসে বাস্তবায়িত একটি কার্যক্রম। জনমূখী এ কার্যক্রম ১৯৯৬ সালে গৃহীত হয় যার বাস্তবায়ন শুরু হয় ১৯৯৮ সালে। ২৬ এপ্রিল ২০০০ সালে গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গীপাড়া উপজেলার পাটগাতী ইউনিয়নের গিমাডাঙ্গা কমিউনিটি ক্লিনিক উদ্বোধনের মাধ্যমে কমিউনিটি ক্লিনিক সেবা কার্যক্রমের শুভ সূচনা করেন। ১৯৯৮-২০০১ সময়ে ১০০০০ এর অধিক কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মিত ও অধিকাংশই চালু করা হয় এবং জনগণ সেবা পেতে শুরু করে। দীর্ঘদিন অব্যবহৃত থাকায় নদীভাংগন ও অন্যান্য কারণে ৯৯টি কমিউনিটি ক্লিনিক ধ্বংস হয়ে যায় এবং ১০৬২৪টি বিদ্যমান থাকে। পরবর্তীতে ২০০৯ সাল হতে Revitalization of Community Health Care Initiativs in Bangladesh (RCHCIB) শীর্ষক প্রকল্পের মাধ্যমে কমিউনিটি ক্লিনিক পুনঃরুজ্জীবিতকরণ কার্যক্রম শুরু হয়। এ কার্যক্রমের মাধ্যমে ১৯৯৮-২০০১ সময়ে নির্মিত কমিউনিটি ক্লিনিকগুলির প্রয়োজনীয় মেরামত, জনবল পদায়ন, ঔষধ ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহ পূর্বক এবং নতুন নির্মিত কমিউনিটি ক্লিনিক পর্যায়ক্রমে চালু করা হয়। এটি ২০১৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।
কমিউনিটি ক্লিনিক পূনঃরুজ্জীবিতকরণের শুরু হতেই স্বাস্থ্য সেবার মূলধারার সাথে সমন্বয় রেখে কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। কমিউনিটি ক্লিনিকের কর্মকান্ড মাধ্যমে স্বাস্থ্য সেবার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় জুলাই ২০১১ হতে RCHCIB প্রকল্পের পাশাপাশি HPNSDP এর আওতায় Community Based Health Care (CBHC) অপারেশনাল প্ল্যান এর কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। RCHCIB প্রকল্পের মেয়াদ অন্তে জুলাই ২০১৫ হতে CBHC অপারেশনাল প্ল্যান এর মাধ্যমে কমিউনিটি ক্লিনিক এর সকল কার্যক্রম বাস্তবায়িত হয়েছে যা ডিসেম্বর ২০১৬ তে সমাপ্ত হয়েছে।
বর্তমানে কমিউনিটি ক্লিনিক কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে ৪র্থ সেক্টর (৪র্থ এইচপিএনএসপি) কর্মসূচিতে Community Based Health Care (CBHC) অপারশেনাল প্ল্যান জানুয়ারি ২০১৭ হতে জুন ২০২৩ মেয়াদে বাস্তবায়িত হচ্ছে।
উল্লখ্যে যে, কমিউনিটি ক্লিনিক কার্যক্রমকে গতিশীল ও টেকসই করার লক্ষ্যে মহান জাতীয় সংসদে ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৮ কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্ট বিল পাশ হয়। অতঃপর মহামান্য রাষ্ট্রপতির সম্মতিক্রমে ৮ অক্টোবর ২০১৮ আইনটি গেজেট আকারে প্রকাশিত হয় (২০১৮ সালের ৫২ নং আইন)। এই আইনের বলে কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্ট একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা। বর্তমানে কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টের আওতাধীন Community Based Health Care (CBHC) অপারশেনাল প্ল্যানের মাধ্যমে কমিউনিটি ক্লিনিকসমূহ পরচালিত হচ্ছে।
কমিউনিটি ক্লিনিক পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশীপ (পিপিপি) এর একটি অনন্য উদাহরণ। সব কমিউনিটি ক্লিনিক গড়ে উঠেছে জনগণের দান করা জমিতে। সরকার ভবন নির্মাণ, সেবাদানকারী নিয়োগ, ঔষধসহ প্রয়োজনীয় যাবতীয় যন্ত্রপাতি ও উপকরণ সরবরাহ করছে। পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা করছে সরকার এবং জনগণ সম্মিলিতভাবে। প্রতিটি কমিউনিটি ক্লিনিক পরিচালনার জন্য সমাজের প্রতিনিধিত্বশীল অংশ নিয়ে ১৩-১৭ সদস্য বিশিষ্ট (এর মধ্যে অন্ততপক্ষে ৪ জন মহিলা) একটি কমিউনিটি গ্রুপ (সিজি) আছে। এই পরিচালনা কমিটির (সিজি) সভাপতি হচ্ছেন সংশ্লিষ্ট ওর্য়াডের নির্বাচিত ইউনিয়ন পরিষদ মেম্বার। সিসি পরিচালনা ও জনগণকে সিসি হতে সেবা গ্রহণে উদ্বুদ্ধকরণে প্রতিটি কমিউনিটি গ্রুপকে সহযোগিতার জন্য ১৩-১৭ সদস্য বিশিষ্ট ৩টি সাপোর্ট গ্রুপ গঠন করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তার ইউনিয়নের সবগুলো সিসি’র প্রধান পৃষ্ঠপোষক। সরকারি সেবাদানকারীগন এই কমিটিগুলোকে প্রয়োজনীয় কারিগরি ও সেক্রেটারিয়েল সাপোর্ট প্রদান করে থাকে। সিবিএইচসি কার্যক্রমের আওতায় কমিউনিটি গ্রুপ ও কমিউনিটি সাপোর্ট গ্রুপ সদস্যদের প্রশিক্ষণ/ওরিয়েন্টেশন প্রদান করা হয়েছে।